তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউবিন। গতকাল বিকেলে কানাডার টরন্টো এলাকার কাছাকাছি একটি ক্যানু দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন। জানা গেছে, তিনি এবং তার দুই বন্ধু লাইফ জ্যাকেট ছাড়া ক্যানুতে ছিলেন। তিনজনের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। একজন তীরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। আল্লাহ যেন উভয়কে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
আব্দুল্লাহ হিল রাকিব পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ওষুধ, প্রযুক্তি ও আবাসন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন সফল এই উদ্যোক্তা। টিম গ্রুপের ১২টি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সাড়ে ১৮ হাজার কর্মী। তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৪৫ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার কাছাকাছি। এই আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসা থেকে আসে। এর মধ্যে দেশের ভেতরেও পোশাকের ব্র্যান্ড টুয়েলভ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাঁচ বছরের যাত্রায় বর্তমানে ব্র্যান্ডটির বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৪।
কর্ম জীবন : বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন ডেকো গ্রুপে, সেটি ১৯৯২–৯৩ সালের কথা। সেই শিক্ষকের সঙ্গে কাজ শুরু করলেন রাকিব। তবে পছন্দ না হওয়ায় দুই মাস পর তা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন শিক্ষক তাঁকে নিয়ে যান ডেকোর এমডির কাছে। রাকিবের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে পছন্দ হলো প্রতিষ্ঠানটির এমডির। তিনি রাকিবকে তাঁদের পোশাকের ব্যবসায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। মাসে বেতন ৭ হাজার টাকা। পরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বহুজাতিক একটি বায়িং হাউসে ৪৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি নেন রাকিব। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিখ্যাত খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড গ্যাপে যোগ দেন আবদুল্লাহ হিল রাকিব। তখন ঢাকা থেকে বিমানে করে গ্যাপের হংকং অফিসে গিয়ে জয়েন করেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে গ্যাপের কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
ব্যবসায়ী হিসেবে যাত্রা : গ্যাপে যোগ দেওয়ার ছয় মাস পর রাকিবকে সিঙ্গাপুর কার্যালয়ের অধীনে স্থানান্তর করা হয়। তখন প্রতি সপ্তাহে সিঙ্গাপুর যেতেন। এক পর্যায়ে গ্যাপের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার মনস্থির করেন। তখন সিঙ্গাপুরের সেই বায়িং হাউসের মালিক ব্যবসা করার প্রস্তাব দেন। রাজি হয়ে যান রাকিব। মুনাফার অংশীদারত্বে ১৯৯৯ সালে একটি বায়িং হাউস করেন আবদুল্লাহ হিল রাকিব। ঢাকায় হয় লিয়াজোঁ অফিস। সেটির দায়িত্ব নেন তিনি। বিভিন্ন কারখানা থেকে পোশাক বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতেন। প্রথম বছর ৭০ লাখ ডলারের ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্জন করেন রাকিব। ২০০৫ সালে টেক্সবো ১৫ কোটি ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি কারখানা না থাকলে ক্রয়াদেশ দিতে চাচ্ছিল না। সে জন্য কারখানা করার তাগিদ অনুভব করেন রাকিব। তবে তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার বলতেন, কারখানায় বিনিয়োগ করলে তুমি টাকা দেখবা না, খালি মেশিন দেখবা। পরে অবশ্য দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান কিনে দ্রুত উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক পর্যায়ে কিছু বিষয়ে মতের মিল না হওয়ায় নিজেই বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন রাকিব।
২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে রূপগঞ্জের গ্রামটেক নামের বন্ধ এক নিটিং ও ডায়িং কারখানা কিনে নেন। ছয় লাইনের কারখানাটির দায়দেনা ছিল ৩২ কোটি টাকা। নিজের দুটি জমি বিক্রি করে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা প্রথম কিস্তি দেন। সেই কারখানাকেই তিনি লাভজনক করেন। ছয় লাইন থেকে কারখানাটিকে ৩৬ লাইনে নিয়ে যান। বর্তমানে কারখানাটির কোনো দায়দেনাও নেই।
কারখানার উৎপাদন শুরুর আগেই ক্রয়াদেশ পেয়েছিলেন রাকিব। বায়িং হাউসের ব্যবসা করার সুবাদে অনেক ক্রেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি কারখানা করছেন শুনে জার্মানির একজন ক্রেতা মেইল করে ৩০ লাখ পিছ টি–শার্টের ক্রয়াদেশের পিও শিট পাঠিয়ে দেন।
বন্ধ একটি কারখানা চালু করে সাফল্য পাওয়ায় রাকিবের কাছে আবারও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা অন্য আরেকটি রুগ্ণ সোয়েটার কারখানা কেনার প্রস্তাব নিয়ে যান। আশুলিয়ার ধউর এলাকার কারখানাটি কিনে নেন রাকিব। একই প্রক্রিয়ায় আশুলিয়ার বাইপালের ফোরআর ইয়ার্ন ডায়িং নামের আরেকটি রুগ্ণ কারখানা কেনেন। সেখানে সুতা রং করে সুবিধা করতে না পারায় বন্ধু আবদুল ওয়াদুদের পরামর্শে জ্যাকেট কারখানা করেন। এভাবে প্রতিটি কারখানাকেই লাভজনক করেন রাকিব। এর আগে উৎপাদন শুরু করতে পুরোনো কারখানা কেনার কৌশল নিয়েছিলাম। তালাবদ্ধ কারখানা দ্রুত লাভজনক করতে পারার কারণে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা রুগ্ণ শিল্প কেনার প্রস্তাব নিয়ে আসতেন। তিনিও কেনা শুরু করলেন। এ ছাড়া বিদেশি কয়েকজন ক্রেতা বন্ধুর অনুরোধে রাকিব চালু করেন টিম সোর্সিং নামে একটি বায়িং হাউস। বর্তমানে দেশীয় মালিকানায় অন্যতম বৃহৎ এই বায়িং হাউসের সঙ্গে কাজ করছে রপ্তানিমুখী ১০৯টি পোশাক কারখানা।
শিক্ষাজীবন : আবদুল্লাহ হিল রাকিবের বাবা ওয়াহিদুর রহমান বিমানবাহিনীতে কাজ করতেন। সেই সুবাদে তেজগাঁওয়ের কোয়ার্টারে বড় হওয়া। শাহীন স্কুলে ছাত্রজীবন শুরু। পরে আদমজীতে পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি, মানে ছাত্র পড়াতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও সেটি অব্যাহত ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বরও পান। তবে গোল বাধল অন্য জায়গায়। ওইবারই প্রার্থীদের উচ্চতার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে মেরিন একাডেমি কর্তৃপক্ষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আটকে যান তিনি। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও ভেঙে পড়েননি রাকিব। নতুন করে শুরু করলেন, তবে এবার আর কোনো লক্ষ্য স্থির করলেন না। যদিও দেশ-বিদেশ ঘোরার ইচ্ছা ভেতরে-ভেতরে উঁকি দিত প্রতিনিয়ত। ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি হন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতেন।
পড়ালেখা শেষে ছয় বছর দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও ২৩ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে নিজেকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আবদুল্লাহ হিল রাকিব।
পরিবার: তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ আবদুল্লাহ হিল রাকিব। সহধর্মিণী আফরোজা শাহীন আর দুই সন্তান মাহির দাইয়ান ও লামিয়া তাবাসসুমকে নিয়ে তাঁর সংসার। যদিও পড়াশোনার জন্য সন্তানেরা বর্তমানে বিদেশে। সঙ্গে তাঁদের মা–ও। ফলে দেশে যখন থাকেন, তখন কাজেই ডুবে থাকেন রাকিব। মাঝেমধ্যেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে বিদেশ যান।