নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ১৫টি প্রতিষ্ঠান ও ৪ ব্যক্তিকে মোট ১.৮২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। তালিকাভুক্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির দায়ে এ জরিমানা করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিএসইসির সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং শিগগিরই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জরিমানার নোটিশ পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের মূল্য প্রায় ৬২% বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাজারের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, এতো বড় মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, জসিম উদ্দিন ও তার সহযোগীরা একাধিক বেনিফিশিয়ারি ওনার (BO) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর অপচেষ্টা চালানো হয়।
বিএসইসির তদন্তে দেখা যায়, এই কেলেঙ্কারির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন মো. জসিম উদ্দিন। তার নেতৃত্বে একটি চক্র অলটেক্সের শেয়ার নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে বাজারে মিথ্যা সংকেত ছড়িয়েছে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভুল সিদ্ধান্ত নেন।
যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে-
এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের নাম প্রকাশ করেছে বিএসইসি। তাদের জরিমানার পরিমাণ নিম্নরূপ:
মো. জসিম উদ্দিনকে ১ লাখ টাকা, দেবরতা সরকারকে ৩ লাখ টাকা, মাসুদুর রহমান শেখকে ১ লাখ টাকা ও শাজালাল আল সাফীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
এছাড়া, ১৫টি প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হয়েছে। এগুলো হলো: জে এস এন্টারপ্রাইজ, শিক্ষিত বেকার সঞ্চয় ও ঋণদান,বগড়া শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়, চাঁদপুর শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়, ওয়্যারলেস বাজার শিক্ষিত বেকার,শিক্ষিত বেকার কেন্দ্রীয় সঞ্চয়, চন্দ্র শিক্ষিত বেকার যুব, ফরিদগঞ্জ শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়, এসবি আমাদের পণ্য আমাদের বাজার, গ্রীডাকলিন্ডিয়া শিক্ষিত বেকার, পাটোয়ারী বাজার শিক্ষিত ও বেকার সঞ্চয়,শাহরাস্তি শিক্ষিত বেকার এসআরএস,মতলব শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়, রূপসা শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়, এসবিসিএল হাউজিং ও তোরামনসিরাত শিক্ষিত বেকার সঞ্চয়।
অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে আরও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ৩৮০.৭৭ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সোনালী ব্যাংক অলটেক্সের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার ঘোষণা দেয়। নিলামে তোলার তালিকায় রয়েছে: ১৪.৭ একর জমি, কারখানা ও অফিস ভবন ও কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিএসইসি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের আর্থিক অবস্থা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
কোম্পানির নিরীক্ষক (অডিটর) তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, অলটেক্স সোনালী ব্যাংকের ঋণের ওপর সুদ হিসাব করেনি। অথচ ব্যাংকের ঋণচুক্তি অনুযায়ী সুদের হার ১০%, যা পরিশোধযোগ্য থাকলে কোম্পানির অতিরিক্ত ২৬ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার কথা। কিন্তু সুদ হিসাব না করায় অলটেক্সের করপূর্ব মুনাফা অতিরিক্ত ২৬ কোটি টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।
এছাড়া, অলটেক্সের হিসাব অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ২২৮ কোটি টাকা, কিন্তু ব্যাংকের হিসাবে এটি ২৬১ কোটি টাকা।
আলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকে অলটেক্স ২৮ লাখ টাকা লোকসান করেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম (২০২৩ সালে লোকসান ছিল ১.৪০ কোটি টাকা)।
অলটেক্সে ইন্ডাস্ট্রিজ শেয়ার সবশেষে পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের কাছে রয়েছে ৩৮.৩৫%। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১০.৫০% ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫১.১৫% শেয়ার রয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় বিএসইসির কঠোর পদক্ষেপ শেয়ারবাজারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আরও সক্রিয় হলে বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।